শিতাংশু গুহ, ২৭শে জানুয়ারি ২০১৯।। নচিকেতার একটি ছবি প্রায়শ: সামাজিক মাধ্যমে দেখি। খুব বেশিদিন পুরানো নয়, সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে যান, সেই সুবাদে গ্রামের পৈতৃক ভিটা দর্শন করেন। ছবিটি বাপদাদার মাটির ভিটার বারান্দায় বসে ক্রন্দনের। তার ডানপা মাটিতে এলায়িত; বা-পা হাটুগেড়ে; ডানহাত মাটিতে, পাঁচটি বলিষ্ট আঙ্গুল পৃথক ও প্রসারিত; বাঁ-হাত দিয়ে বাঁ-চোঁখ মুছছেন; ডানচোখ বন্ধ। মলিন মুখমণ্ডলে দু:খের ছাপ স্পষ্ট।
কণ্ঠশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীকে পরিচয় করিয়ে দরকার নেই, সবাই তাকে চেনেন। তাঁর আদিবাড়ি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার চেচ্নিয়াপুর গ্রামে। তিনি ভিআইপি। বাংলাদেশ সফরে গেলে হেলিকপ্টারে নিজ বাসভূমে যান এবং ভিটায় বসে কিছুক্ষন কাঁন্না করেন, হয়তো কান্না করে মনের দু:খ হালকা করার চেষ্টা করেন?
ঐ ভিটায় এখন বসবাস করেন জনৈক আনোয়ার শিকদার। ক’হাত বদলিয়ে তিনি মালিক জানিনা, বা তাঁর কোন দোষ আছে, তাও নয়, কিন্তু এটিই বাংলাদেশের স্বাভাবিক চিত্র। হিন্দুর বাড়ী মুসলমানের দখলে। সাতচল্লিশে এখনকার বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডে অধিকাংশ বাড়িই ছিলো হিন্দুর। এখন সম্পূর্ণ উল্টো। শুধু ভারত-ভাগ কি এর কারণ? না।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ যদি শুধুমাত্র কারণ হতো, তাহলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আগরতলা বা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সব মুসলমানের বাড়ী হিন্দুর হয়ে যেতো? তা হয়নি। এই চিত্র পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের। সাদামাটাভাবে যেকেউ হয়তো বলবেন, পাকিস্তান নামক একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পত্তন এর কারণ। আসলেই কি তাই?
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়, কেউ বলেনা। সেখানে প্রতিনিয়ত হিন্দুর সম্পত্তি জোরপূর্বক হাতছাড়া হচ্ছে কেন? হিন্দুরা দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। এর কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্রটি সাম্প্রদায়িক। ওপরের স্তরের মানুষগুলো, বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী বর্ণচোরা অ-সাম্প্রদায়িক। অনেকে আবার ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক। সরকারে ভালো লোক যে নেই, তা নয়, তাঁরা খুব একটা কিছু করতে পারেন না?
বাংলাদেশ নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশ, এ বাক্যটি আপনি সবার মুখেই শুনবেন! সরকারকে এখানে বলতে হয়, দেশ মদিনা সনদে চলবে। ইসলামের বিরুদ্ধে কোন আইন হবেনা। ধর্মনিরপেক্ষতা বা বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়? রাষ্ট্রধর্ম উঠানো যাবেনা, সংবিধানের ললাট থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ উঠায় সাধ্য কার? ক্ষমতায় থাকতে বা আসতে এদেশে মৌলবাদের সাথে আপোষ করতে হয়?
কলকাতায় জয়শ্রী-আলমগীরের বিয়ে হয়েছিলো মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ীতে, মিডিয়া ফলাও করে তা ছেপেছিলো। ঢাকার কোন বুদ্ধিজীবীর বাড়িতে কি উল্টোটা সম্ভব? সম্ভব নয়। এতে মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে? আর ইসলামের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মিথ্যা অভিযোগে ইতিমধ্যে রামু, নন্দীরহাট, নাসিরনগর, রংপুর ও অন্যত্র হাজারো হিন্দুর বাড়িঘর পুড়ে ছাই, দেশত্যাগী সংখ্যা অগুনতি। সংখ্যালঘু নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে বাংলাদেশে ইসলামী অনুভূতি, নাবালিকা ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ, লুটপাট, সম্মানহানি খুবই কার্যকর।
এসব কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো প্রতিদিন হিন্দুর সংখ্যা কমছে। বাহাত্তরে ১৯.৭% থাকলেও এখন হিন্দু ৯%। সংখ্যালঘু ১০.৭%, এটি সরকারি হিসাব, গোঁজামিল দেয়া। বাংলাদেশের মানুষ বলতে পছন্দ করেন যে, দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নহর বইছে। তাঁরা আরো বলতে চান, হিন্দুরা এমনিতেই ভারত চলে যাচ্ছেন? কট্টরপন্থীরা বলেন, ‘হিন্দুরা আমানত’। আমানতের শাব্দিক অর্থ যাই হোক, প্রকৃত মানে হচ্ছে, ‘গৃহস্তের মুরগী পোষা’?
নচিকেতা বিখ্যাত মানুষ, তাই তাঁর ছবি মিডিয়ায় এসেছে। এই ছবি লক্ষকোটী হিন্দুর প্রতিচ্ছবি। ‘ন্যাশন্স লাষ্ট ক্যজাল্টি’ বই বলছে, সাতচল্লিশ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫কোটি হিন্দু পূর্ব-পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতবড় উদ্বাস্তু ঘটনার কিন্তু তেমন কোন প্রচার বা গুরুত্ব নেই? এই তালিকায় নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যাতি বসু, বর্তমান ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব, শিল্পী নচিকেতা সবাই আছেন।
এদের কান্নাকাটি, বা নীরব বিলাপ মাঝে-মধ্যে দেখা বা শোনা যায়? সাধারণ যাঁরা গেছেন, তাদের মুখেও প্রায়শ: অনেকেই শুনে থাকবেন তাঁরা কতবড় জমিদারি ফেলে গেছেন? কিন্তু কেন তাঁরা যেতে বাধ্য হয়েছেন, তা কিন্তু বলেননা। অমর্ত্য সেন প্রায়শ: বাংলাদেশের প্রশংসা করেন, যা বাংলাদেশী হিসাবে শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু কেন তিনি বাপ্-ঠাকুরদার হাত ধরে দেশ ছেড়েছিলেন তা বলতে লজ্জা পান? বা বললে সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবেন, বা এরপর বাংলাদেশ সফরে গেলে সমাদর কমে যাবে?
না, দাদা তা কমবে না? কারণ আপ্যায়নে আমাদের মানে বাংলাদেশীদের জুড়ি নেই। আমাদের সুবিখ্যাত জামদানী শাড়ি, বা পদ্মার ইলিশ অতীতের সকল দু:খ-কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে। তাই কলকাতার বাবুরা অনেকে বা অভিনেত্রী রুপা গাঙ্গুলী চব্বিশ ঘণ্টা ঢাকায় কাটিয়ে সার্টিফিকেট দিতে পারেন যে, বাংলাদেশের হিন্দুরা ভালো আছে। পশ্চিমবাংলা বা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ভুলেও বাংলাদেশের হিন্দুদের কথা মুখে অনেননা? দিদিকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, কলকাতার মেয়র একজন মুসলমান, ঢাকা বা করাচীতে একজন হিন্দু মেয়র কি চিন্তা করা যায়?
এ এক চমৎকার খেলা। কবি শ্রীজাত লাঞ্ছিত হয়েছেন, সবাই অসহিষ্ণুতা দেখতে পাচ্ছেন? তসলিমা নাসরিনকে ঝেটিয়ে বিদায় করার সময় কোন অসহিষ্ণুতা ছিলোনা! ফারুক আব্দুল্লাহ এতদিন পর ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন দেখছেন? কাশ্মীর থেকে হিন্দু পন্ডিতদের মেরেকেটে বিদায়ের সময় কোন ধর্মীয় বিভাজন ছিলোনা? ব্রিগেডে যাঁরা লম্বা ভাষণ দিয়েছেন, এরাও কেউ বাংলাদেশের হিন্দুদের কথা ভাবেন না? ভারত আমার দেশ নয়; ভারত নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই?
আমার না থাকলেও, অনেকের আছে। ভারতের রামমন্দির ঘটনায় বাংলাদেশে হাজারো মন্দির পুড়ে; হিন্দু দেশচ্যূত হয়? ‘হজরত বাল’ চুরি যাওয়ার মিথ্যা প্রচারণায় পূর্ববঙ্গে দাঙ্গায় অসংখ্য হিন্দু মরেছে। পাকিস্তান হিন্দুশূন্য হয়েছে, অত্যাচার ছিলো, আরো ছিলো ভারতের উদাসীনতায়। বাংলাদেশও হিন্দুশূন্য হবে বিশেষত: ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজনীতিকদের অতিমাত্রায় মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে এরা ক্ষুদ্র গন্ডিতে ‘প্রকাশ্যে গরু খাওয়া ও মুসলিম তোষণ’ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে?
নচিকেতার কান্নার মূল্য তিনিই বুঝবেন যিনি বাপদাদার ভিটে হারিয়েছেন। বিশেষত: যারা হারাতে বাধ্য হয়েছেন। এ যন্ত্রণার ব্যাথা শুধু হৃদয় দিয়েই বোঝা যায়। নচিকেতারা অবশ্য সব বুঝেও কথা বলেন না, পাছে সাম্প্রদায়িক হয়ে যান? সাম্যের গান গাওয়া ভালো, তবে এটাও সত্য ‘শান্তির জন্যে মাঝেমধ্যে যুদ্ধের প্রয়োজন’। আইসিস, আল-কায়দা’কে ভালবাসার গান শুনিয়ে শান্তি আসেনা।
USA: Radicals attack Hindu Temple, vandalize it with sayings like ‘Jesus is the only Lord’
যাহোক, লোকে বলে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বুঝতে হলে আপনাকে হিন্দু হতে হবে, নইলে বোঝা কঠিন, অন্যকে বোঝানো আরো কঠিন। তবে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্তু হিন্দুরা কেন বুঝেন না, তা রহস্যময়? হয়তো বোঝেন, বলেন না, কারণ স্বজাতির পক্ষে বললে অসাম্প্রদায়িক ছাপ পড়তে পারে! নেতাজী সুভাষ বসু ছিলেন আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। নিজেকে প্রগতিশীল ও অসম্প্রদায়িক প্রমান করতে কবির সুমন-দের মত ভন্ডামী বা মোল্লা তোষনের প্রয়োজন হয়না?
বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে হিন্দু বা সংখ্যালঘুরা বিতাড়িত হচ্ছেন, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বা নির্যাতনের কারণে। এটি নীরব সন্ত্রাস। রাষ্ট্রের কাঠামোটি সাম্প্রদায়িক। ঠাট্টা করে অনেকে বলেন, বার্মা আহম্মকের মত সব রোহিঙ্গাকে একসাথে বের করে দিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী চাপে আছে? ওদের উচিত ছিলো, বাংলাদেশ থেকে ট্রেনিং নেয়া, কি-করে পরিকল্পিত উপায়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন চালিয়ে দেশ থেকে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করতে হয়? তাতে সাপও মরতো, লাঠিও ভাঙ্গতো না?